মতামত: সংবাদ বিশ্লেষণ
এম. আর. কমল
১৯৯১ সালের দিকে যখন আমার সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি; তখন সিনিয়রদের কাছে শুনতাম একজন সাংবাদিক সাধারণত আরেকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কলম ধরে না। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলতেন- ‘কাকের মাংস কাকে খায় না’। প্রায় ৩৩ বছরের দীর্ঘ পেশাগত পথ পাড়ি দিয়ে আজকে যে বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছি, তখন সেই সিনিয়রদের ডেকে এনে দেখাতে ইচ্ছে করে আজকের দিনের সাংবাদিকতার চিত্র। তাঁরা অনেকেই সাংবাদিক সমাজের এই পংকিলতা দেখার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। বেঁচে থাকলে তাঁরা হয়তো পেশার এ অধঃপতন সইতে পারতেন না।
কাকের মাংস কাকে না খেলেও বেদনাভরা হৃদয় অনেক সময় সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও কলম ধরতে বাধ্য হতে হয়। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- ‘এটা কোন সাংবাদিকতার এথিক্স’? জাতীয় প্রেসক্লাবে একজন সিনিয়র দুঃখ করে বলছিলেন, ‘সমাজে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকারের কথা বলেন সাংবাদিকরা, আর সেই সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার বঞ্চিত হয়’। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তখনো জন্ম হয়নি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা মানবাধিকার সংস্থা নামধারী কোনো সংগঠন তখনো পর্যন্ত ছিলো না। মিডিয়া বলতে তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন আর হাতেগোনা কিছু সংখ্যক সংবাদপত্রকেই বুঝানো হতো। কারণ তখনো এতো এতো পত্রিকা এবং কোনো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ারই জন্ম হয়নি।
তাদের মধ্যে যে কয়টি পত্রিকা নিয়মিত বেতন দিতো তাদেরও ৩ মাসের বেতন সব সময় বকেয়া থাকতো। বর্তমানে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। দেশে অগণিত পত্রিকা এবং প্রায় অর্ধশত টিভি চ্যানেলের জন্ম হয়েছে। আগে তো ৩ মাস পরে হলেও এক মাসের বেতন মালিক দিতেন। এখন ২/৪টি প্রতিষ্ঠান বাদে অধিকাংশ পত্রিকার মালিকের সাংবাদিকদের বেতন দেয়ার কোনো প্রয়োজনই হয় না। সাংবাদিকদের গলায় একটা আইডি কার্ড ঝুলানোর পারমিশন দিলেই চলে। নিউজ লিখতে পারুক বা না পারুক ওই কার্ডের বলে সাংবাদিক সাহেব নেমে পড়েন চাঁদাবাজী থেকে শুরু করে নানা রকম অপকর্মে।
এ কর্মে মালিকরাই বা কম যাবেন কেন? মওকা বুঝে তারাও একই পন্থায় উপার্জনের ধান্ধা করে অনেকেই বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক বনে গেছেন।টিভি চ্যানেলগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। ২/৪ জন নীতিবান সাংবাদিক আর ২/৪টি চ্যানেল বাদে অধিকাংশ চ্যানেলই চাঁদাবাজী থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে জড়িত। আর এসব করে তারা রাতারাতি বুর্জোয়া শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের ক্ষমতার দীর্ঘকালীন সময়ে তারা পেশাদারিত্ব শিকেয় তুলে স্বৈর শাসনের চামচাগিরিতে লিপ্ত থেকে নানা রকম সুবিধা নিয়েছেন। সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনা না করে তাদের সাফাই গাইতে ব্যস্ত ছিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈর শাসকের পতন হলে তারা সাথে সাথেই বোল পাল্টে নিয়েছেন। আছেন বহাল তবিয়তে এবং চালিয়ে যাচ্ছেন চাঁদাবাজীসহ যতোসব অপকর্ম । এরকম অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে মিডিয়া পাড়ায়। এই অপকর্মে লিপ্ত শ্রেণীটির কারণেই ‘সাংবাদিক’ শব্দটির সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃত সাংবাদিকের মূল্যায়ন নেই; মূল্যায়ন হয় ধান্ধাবাজদের। আর তাদের মূল্যায়ন মানে অবমূল্যায়ন যেটা বুঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। ‘সাংবাদিক’ শব্দটিকে ব্যাঙ করে মানুষ এদেরকে ‘সাংঘাতিক’ শব্দে আখ্যায়িত করে থাকে। এরা সর্বদা ব্যস্ত থাকে কাকে বা কোন প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে বা হুমকী ধামকী দিয়ে কিছু খসানো যাবে সেই ধান্ধাই। প্রসঙ্গত এরকমই একটা ঘটনার অবতারণা করছি এখানে। ৫ আগষ্ট স্বৈর সরকারের পতনের পরে ঘটাটি ঘটে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এলাকায়। ঘটনাটি ঘটে ‘দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লি.’-এর সাথে। এই হাউজিং সোসাইটির অফিসটি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের নাম আগষ্টিন পিউরিফিকেশন। তিনি খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের একজন নেতা, একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং গণ্যমান্য ব্যক্তি।
বাংলাদেশের সকল নির্বাচনী এলাকাতেই লোকাল এমপিদের সাথে ওই এলাকার কিছিু সংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের স্বাভাবিক একটি সুসম্পর্ক থাকে। ঠিক একইভাবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও তার এলকার কিছু সংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা সাধারণ সম্পর্ক ছিলো। তাদেরই একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আগষ্টিন পিউরিফিকেশন। এরকম সম্পর্ক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে শত শত মানুষের ছিলো। আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের সাথে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেনাজানা ছিলো মাত্র। কোনো মাখামাখি সম্পর্ক ছিলো না। এই চেনাজানার সম্পর্কটাকে কেন্দ্র করেই একটি টিভি চ্যানেল লেগে পড়েন আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের পিছনে। শত শত মানুষের সাথে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের চেয়ে বেশি সখ্যতা থাকলেও অর্থনৈতিক বিচারে বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে তারা কেউই আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের সমকক্ষ নন। নিজের যোগ্যতা এবং সুদক্ষ পরিচালনায় ‘দি মেট্রাপলিটন খ্রীষ্টান হাউজিং সোসাইট’কে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান আগষ্টিন পিউরিফিকেশন। যা অনেকের কাছেই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোম্পানিটির অনেক উন্নতি হয়। খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের আবাসন সমস্যা নিরসনে কোম্পানিটি যুগান্তকারি ভূমিকা পালন করে আসছে। অন্যদিকে আগষ্টিন পিউরিফিকেশন নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত হাউজিং ব্যবসায়ী। তাঁকে কোনঠাসা করতে পারলে মোটা দাগে সুবিধা নেয়া যাবে মনে করে একটি টিভি চ্যানেলের চোখ পড়ে আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের উপর। স্বৈর সরকারের পতনের পর থাবা বসাতে আসে এবং কোণঠানা করতে অপচেষ্টা করে আগষ্টিন পিউরিফিকেশনকে। কিন্তু টিভি চ্যানেলটি তাঁর বিরুদ্ধে নিউজ করার মতো কোনো ক্লু খুঁজে পায় না। আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণের উদ্যোগ নেয় তারা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সকল অপকর্মের দোসর হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করে নিউজ প্রচার করবেন বলে হুমকী দিতে থাকেন। তবে যদি মোটা দাগে তাদেরকে সুবিধা প্রদান করা হয় তাহলে তারা সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকবেন। কিন্তু সৎ, কর্মঠ ও নির্ভিক আগষ্টিন পিউরিফিকেশন তাদের এই অনৈতিক দাবি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। জীবনে কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দেইনি। এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে লোকাল এমপির সাথে যেটুকু পরিচয় থাকার কথা তার বাইরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না। এখনো নেই। তিনি কোনো দুর্নীতি করে থাকলে সেটা তার ব্যাপার সেসবের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং আমার শ্রমে, ঘামে, মেধায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান বা আমি কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবো না।’
অবশেষে তারা ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও তথ্য প্রমাণ ছাড়া কয়েকটি নিউজ প্রচার করেন। কিন্তু কী নিউজ প্রচার করবেন? তারা শত চেষ্টা করেও আগষ্টিনের দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায় না। শেষে আগষ্টিন পিউরিফিকেশনের ব্যক্তি চরিত্রের উপর আঘাত হানে। একজন নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের কথা জুড়ে দিয়ে তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপকর্মের দোসর প্রমাণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। পরিশেষে তাকে অবৈধ সম্পদের মালিক প্রমাণ করার চেষ্টা করে নিউজ প্রচার করে।
এই টিভি চ্যানেলের কাছে আমার প্রশ্ন- আপনাদের কি জানা আছে যে হাউজিং ব্যবসা একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা? আগষ্টিন পিউরিফিকেশন নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত হাউজিং ব্যবসায়ী? বিশ বছর ধরে সফলভাবে একটা হাউজিং কোম্পানি চালাতে পারলে সেই কোম্পানির চেয়ারম্যান একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন এই সাধারণ বুদ্ধিটুকুও কি আপনাদের লোপ পেয়েছে? আর তিনি যদি অন্যায় কিছু করে থাকেন তাহলে মোটা দাগের সুবিধা নিয়ে তাকে দায়মুক্তি দেয়া কি আপনাদের পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে? আপনারা কি জানেন বসুন্ধরা গ্রুপ বা যমুনা গ্রুপ হাউজিং ব্যবসা করে কতো সম্পদের মালিক হয়েছে এবং তারা কতো পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন?
এই আপনাদের মতো অপসাংবাদিকদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়েই বসুন্ধরা গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ এবং এ কে আজাদের মতো একজন নীরেট ব্যবসায়ীকেও সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলের মালিক হতে হয়েছে। অথচ এরা কেউই পেশাগতভাবে সাংবাদিক নন এবং কখনো ছিলেনও না। তাহলে কি আপনাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আগষ্টিন পিউরিফিকেশনকেও একটা টিভি চ্যানেলের মালিক হতে হবে?
পরিশেষে বলতে চাই এসব অপসাংবাদিকতা বন্ধ করুন। সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। জাতির বিবেকেরই যদি হয় এই অবস্থা তাহলে জাতির কী হবে? নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের কথা কে বলবে? আপনি নিজেই যদি অন্যায়ের সমুদ্রে ডুবে থাকেন তাহলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন মুখে কথা বলবেন?