
লেখক: ফাদার নরেন জে. বৈদ্য
যীশুর পুনরূত্থানের সর্বোত্তম প্রমানটি হচেছ তাঁর বিশ্বাসী মন্ডলীর খ্রীষ্টিয় সমাজের অস্তিত্ব। যীশুর পুনরুত্থান ব্যতিরেখে খ্রীষ্টবিশ্বাসীর বিশ্বাস ও জীবন নিরর্থক ও প্রশ্নবোধক। “খ্রীষ্ট যদি পুনরুত্থিত না হয়ে থাকেন তাহলে, মিথ্যই তোমাদের বিশ্বাস; তোমরা আজও তোমাদের সেই পাপী অবস্থাতেই পড়ে আছ!” (১ করি ১৫:১৭)। যীশুর পুনরুত্থান সকল পাপ ও মন্দতার ওপর সুনিশ্চিত বিজয়। পুনরুত্থানের বারতা হলো পুনরূত্থিত খ্রীষ্টের জোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে নতুন মানুষে রূপান্তরিত হওয়া। পাপময় জীবন পরিত্যাগের ভাবনায় হোক পুনরুত্থান উৎসব। “আসুন আমরা আশায় একসাথে যাত্রা করি” পোপ মহোদয়ের তপস্যাকালের বাণীর প্রেরণায় যাপিত জীবনে আমাদের যাত্রা হোক আত্ম শুদ্ধিতে। যীশুর জন্ম জয়ন্তী জুবিলী বর্ষে আমরা আলোর তীর্থযাত্রী হই। পুনরুত্থিত খ্রিস্টের আলোয় নিজেকে আলোকিত করি ও অন্যকে আলোকিত হতে সহায়তা করি।
পুনরুত্থিত খ্রীষ্ট আমাদের আশা
খ্রীষ্টের পুনরূত্থান আমাদের পুনরুত্থানের নিশ্চয়তা দেয়। খ্রীষ্ট যদি পুনরূত্থিত না হতেন স্বর্গ দ্বার থেকে যেত রূদ্ধ, ভোগ করতে পারতাম না জীবন বৃক্ষের অমৃত ফল। আমাদের মধ্যে জাগে প্রাণের সাড়া। নব সৃষ্টির আশা ও আশ্বাসে ভরে উঠে বুক। তাই তো খ্রীষ্টের এই পুনরূত্থানের ঘটনা স্মরণ করে আমরা বিজয়োল্লাসে গেয়ে উঠি : ‘জয় ধ্বনী হোক রে আজি জয়ধ্বনী হোক ....’।
আধ্যাত্মিক লেখক টমাস মেরটর বলেন: আমরা কেবল এটাই বিশ্বাস করতে আহুত নই যে, খ্রিষ্ট একদিন মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থান করেছেন- বরং আমরা আহুত হয়েছি যাপিত জীবনে পুনরুত্থানের অভিজ্ঞতায় প্রতিদিন পথ চলতে- যীশুকে অনুসরণ করতে যিনি আমাদের মধ্যে জীবিত আছেন।
“খ্রীষ্ট যেমন পিতার মহিমাশক্তিতে পুনরুত্থিত হয়েছেন, তেমনি আমরাও যেন এক নবজীবনের পথে চলতে পারি। খ্রীষ্টের সঙ্গে আমাদের পুরানো “আমিটা”- ও ক্রুশবিদ্ধ হয়েছে, আমরা যেন আর পাপের দাস হয়ে না থাকি” (রোমীয় ৬:৪,৬)। এই বাণীর বাস্তবায়নই প্রতিদিন আমাদের ব্যক্তি জীবনে পুনরুত্থান ঘটায়।
পুনরুত্থানকালের তাগিদ ও আত্মিক চিন্তাভাবনা
খ্রীষ্টিয় জীবন হচেছ যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যু ও পুনরূত্থানে বিশ্বাস। “মুখে তুমি যদি সকলের সামনে যীশুকে প্রভু বলে স্বীকার কর এবং অন্তরে যদি বিশ্বাস কর যে, পরমেশ্বর তাঁকে মৃতদের মধ্য থেকে পুনরূত্থিত করেছেন, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই পরিত্রাণ লাভ করবে” (রোমীয় ১০:৯)।
সাধু পলের কথা আমাদের হৃদয় স্পশ করুক: “তোমরা যখন খ্রিষ্টের সঙ্গে পুনরুত্থিত হয়েছ, তখন তোমরা সেই সব কিছু পেতে চেষ্টা কর, যা রয়েছে উধ্বলোকে। তোমাদের মনটা সর্বদাই ভরে থাকুক ওই ঊধ্বলোকের যা কিছু,তারই চিন্তায়- যা কিছু এই মর্তলোকের,তার চিন্তায় নয়” (কলসীয় ৩:১)।
যীশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ফলে আমরা “নুতন সৃষ্টি হয়ে ওঠবার সুযোগ পেয়েছি। খ্রিষ্টমন্ডলী ও বিশ্বাসীভক্তের মিলন সমাজ হলো পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের দেহ। খ্রিষ্টীয় জীবন হলো নতুন জীবন, খ্রিষ্টেতে জীবন যাপন। পুনরুত্থিত যীশু খ্রিষ্টের মত চিন্তা ও কাজ করা।
খ্রিস্টিয় আচরণ ও মন্দতা পরিত্যাগের ভাবনায় হোক পুনরুত্থান উৎসব
‘খ্রিষ্ট আমাদের নিস্তার পর্বের মেষশাবক যিনি, তিনি কি বলিরূপে উৎসর্গকৃত হননি? সুতরাং এসো আমরা এই উৎসব উদযাপন করি পুরানো খামির দিয়ে নয়, দুষ্টতা ও অধমের্রও খামি নিয়ে নয়, বরং আন্তরিকতা ও সত্যনিষ্ঠার খামির বিহীন রুটি নিয়ে’ (১ করি ৫:৭-৮) অনৈতিক কার্যকলাপ, বৈষম্য, বিরোধিতা, বিদ্রোহ, বিপ্লব, বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতা. বিদ্বেষ, বিদ্রæপ, বাক-বিতন্ড, অপ্রেম ও অশ্রদ্ধা, অবিচার, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ও প্রতিরোধ, যৌন নিপীড়ন, বাসে ডাকাতি, আত্মিক জীবনে প্রতি উদাসীনতা, মানব নৈতিকতার বিপর্যয়, এবং যুদ্ধ বিগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ন্যায্যতা আজ পদদলিত। স্বজনপ্রীতির জয় জয়াকার। নারীর প্রতি সহানুভুতি নেই। প্রতিশোধ নেওয়া যেন নিত্য দিনের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। র্যাব ও পুলিশের হাতে মানুষ গুম, অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন। বিধ্বস্ত হয়ে গেছে দেশের ব্যাংক খাত। দেশে গত ৮ই ফেব্রুয়ারী থেকে ‘ অপারেশন ডেভিল হান্ট’ বা ‘দুষ্কৃতীবিরোধী অভিযান’ শুরু হয়েছে। এরপরও অন্তর্বতী সরকারআইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সেই প্রশ্ন উঠছে। বৈষম্য দূরীকরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্বিকার। রাজনীতিবিদদের খাসলত পাল্টাচ্ছে না এবং কোন অনুশোচনা নেই। দেশে এখন বাটপার, লেটেরা ও গোঁয়ার গোবিন্দ মব তৈরী হচ্ছে। বৈষম্যহীন দেশ গড়ার প্রত্যয় নেই।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের অন্তর জগতকে যীশু খ্রিস্টের চিন্তার আলোকে আলোকিত করি। সংহিংসতামুক্ত দেশ গড়ি। অন্যায় কাঠামোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা জীবন দেয়, তারা অমরত্ব লাভ করে। পাপ ও মৃত্যুর উপর খ্রিস্টপ্রভুর পুনরুত্থান চেতনা আমাদের অনুপ্রেরণা দান করুক।
আমরা যদি পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের সাক্ষাৎ পাই, তাহলে আমারা তো খ্রিষ্টিয় আচরণ করব। দুনীতির জয়গান গাইতে পারবো না। কথা ও আচরণের ছুরি দিয়ে ভাই বোনদের আহত করবো না। আলোর পথেই চলবো। যখন আমরা একত্রে ন্যায্যতা, শান্তি, পুনমিলন ও মানব উন্নয়নের কাজে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রাখি, আমরা তখন পুনরুত্থানের পথে চলি।
অনুধ্যান : আত্ম জিজ্ঞাসা
আমরা কি সত্যিই পুনরুত্থিত ব্যক্তি? আমরা কি পুনরুত্থিত খ্রীষ্টের স্পর্শ পেয়েছি? লোকেরা কি আমাদের জীবনে পুনরুত্থিত খ্রীষ্টের পদচিহ্ন ছাপ প্রভাব দেখতে পায়? কোথায় আমরা পুনরুত্থিত খ্রীষ্টের সাক্ষাৎ পেতে পারি? আমরা কী করতে পারি যাতে বিশ্বাসীভক্তগণ সত্যিই পুনরুত্থিত খ্রিষ্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে? কী পদক্ষেপ অনুসরণ করলে, আমরা যীশুর পুনরুত্থান সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে সক্ষম হব? যীশুর সঙ্গে পুনরুত্থিত হয়ে নতুন জীবনের প্রতিফলন আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে কী উপায়গুলির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি কি পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে আমরা যীশুর পুনরুত্থানের বার্তা বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রচার করতে সক্ষম হব?
উপসংহার
মানুষের কাছে পুনরুত্থিত খ্রিস্টের মুখচ্ছবি হয়ে উঠি। খ্রীষ্টিয় জীবন তো নেতিয়ে পড়া, ঝিমিয়ে পড়া জীবন। যীশু খ্রীষ্টের পুনরুত্থান উৎসবের ঐকান্তিক কামনা হোক মৃতুঞ্জয়ী খ্রীষ্টের সাথে “ কবর থেকে উঠে” পুনরুত্থিত জীবন শুরু করা। শয়তানের বশবর্তী হয়ে পাপের অবস্থায় না থাকা। যেখানে অন্যায়- অন্যায্যতা ও পাপময়তা ঘটছে, সেখানেই যীশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। দেশের মধ্যে চলমান প্রতিহিংসা, ধ্বংসযজ্ঞ, জীবন বিনাশ অত্যন্ত নির্মমভাবে মৃত্যুর সত্যতা ব্যক্ত করছে। যীশু খ্রিস্টের পুরুত্থান আমাদের শিক্ষা দেয় যে, মন্দতা ও পাপময় জীবন পরিত্যাগ করে আমরা যেন সত্য ও আলোর পথে জীবন যাপন করি।