
ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে যে হামলা-পাল্টা হামলা চলছে, তা মূলত দুই দেশের পুরানো বিরোধের সর্বশেষ পর্ব। ইসরায়েল ও ইরান বছরের পর বছর ধরে রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আর এর তীব্রতা ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে কখনো বাড়ে, কখনো কমে। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার অন্যতম একটি কারণ এটি।
তেহরানের কাছে ইসরায়েল হলো ‘ছোট শয়তান’ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, যাকে তারা ডাকে ‘বড় শয়তান’ বলে। ইসরায়েলের অভিযোগ ইরান ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীকে অর্থায়নের পাশাপাশি ইহুদি বিরোধিতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। ‘দুই প্রধান শত্রুর’ মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটলেও প্রায়শই তা গোপনে হওয়ায় কোনো সরকারই এর দায় স্বীকার করে না।

ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে বিজয়ের পর ইসরায়েলের সাথে দেশটির সম্পর্কে ফাটল ধরে
ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে শত্রুতার শুরু যেভাবে
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। কিন্তু এই সম্পর্ক খারাপ হয় যখন আয়াতুল্লাহ কথিত ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে তেহরানের ক্ষমতা দখল করে। এমনকি শুরুর দিকে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের তৈরির বিরোধিতা করলেও মিশরের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশও ছিল ইরান। সেই সময়ে ইরান ছিল পাহলভি রাজবংশের শাহদের দ্বারা শাসিত একটি রাজতন্ত্র ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র। এই কারণে আরব প্রতিবেশীদের দ্বারা নতুন ইহুদি রাষ্ট্রের প্রত্যাখ্যানকে প্রতিহত করার উপায় হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সরকারপ্রধান ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বের আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তা অর্জনও করেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। রুহুল্লাহ খোমেনি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহকে উৎখাত করে ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র চাপিয়ে দেয়। এই নতুন সরকারের পরিচয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইসরায়েলের ‘সাম্রাজ্যবাদ’কে প্রত্যাখ্যান করা।

খোমেনি এবং ইসলামি বিপ্লবের অন্যান্য নেতারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন
নতুন আয়াতুল্লাহ সরকার ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, ইসরায়েলের নাগরিকদের পাসপোর্টের বৈধতা অস্বীকার করে ও তেহরানে ইসরায়েলি দূতাবাস দখল করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) কাছে হস্তান্তর করে। সেসময় পিএলও ইসরায়েলি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিচ্ছিলো। সংঘাত নিরসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রোগ্রামের পরিচালক আলি ভায়েজ বিবিসিকে বলেন, “ইসরায়েলের প্রতি শত্রুতা ছিল নতুন ইরানি শাসনের একটি স্তম্ভ কারণ এর অনেক নেতা লেবাননের মতো জায়গায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ও প্রশিক্ষণ নেয়, আর তাদের প্রতি এদের অনেক সহানুভূতিও ছিল”। কিন্তু এছাড়াও মি. ভায়েজের বিশ্বাস, “নতুন ইরান নিজেকে প্যান-ইসলামিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। আর একারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে, কেননা অন্য আরব মুসলিম দেশগুলো আগেই এটি বাদ দিয়েছিল”। এভাবেই খোমেনি ফিলিস্তিনের বিষয়টিকে নিজেদের বলে দাবি করতে শুরু করেন আর তার নিজের এবং তেহরানের সরকারি সমর্থনে সেখানে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

তেহরানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে
তবে ভায়েজের মতে, “ইসরায়েলের দিক থেকে ইরানের প্রতি শত্রুতা ১৯৯০ এর দশকের আগ পর্যন্ত শুরু হয়নি। কারণ তার আগে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক বৃহত্তর আঞ্চলিক হুমকি হিসেবে বিবেচিত ছিল”। এমনকি 'ইরান-কন্ট্রা' নামে পরিচিত গোপন কর্মসূচিকে সম্ভব করতে ইসরায়েলি সরকার মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিল। এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানে অস্ত্র সরিয়ে নেয় যেগুলো ব্যবহার করে ১৯৮০ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত দেশটি প্রতিবেশী ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ইসরায়েল ইরানকে তার অস্তিত্বের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে এবং দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার ‘ছায়া যুদ্ধ’
ভায়েজ উল্লেখ করেন যে, সৌদি আরবের মতো অন্য বড় আঞ্চলিক শক্তির মুখোমুখি হওয়া এবং সুন্নি প্রধান আরব ইসলামিক বিশ্বে ইরানের শিয়া প্রধান হবার বাস্তবতার বিষয়ে সচেতন হয়ে “ইরান সরকার তার বিচ্ছিন্নতা উপলব্ধি করে এবং শত্রুরা একদিন তাদের নিজের ভূখণ্ডে আক্রমণ করবে এমন শঙ্কা প্রতিরোধের লক্ষ্যে একটি কৌশল তৈরি করতে শুরু করে”। এভাবেই তেহরানের সাথে যুক্ত সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক প্রসারিত হয় এবং তার স্বার্থের জন্য অনুকূল সামরিক পদক্ষেপ চালায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেবাননের হেজবুল্লাহ, যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘সন্ত্রাসী’র তকমা দিয়েছে। বর্তমানে তথাকথিত এই ইরানি ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত। এদিকে ইসরায়েলও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। বরং ইরান ও তার মিত্রদের আক্রমণ এবং অন্যান্য শত্রুতামূলক কাজের প্রতিরোধ করেছে। তবে প্রায়শই তা তৃতীয় কোনো দেশে যেখানে ইসরায়েল ইরানপন্থী শক্তির সাথে লড়াইরত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন ও সমর্থন করে থাকে। ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে লড়াইকে ‘ছায়া যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে কারণ উভয় দেশই একে অপরের উপর আক্রমণ করেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কেউ তা সরকারিভাবে স্বীকার করেনি। ১৯৯২ সালে ইরানের ঘনিষ্ঠ একটি ইসলামিক জিহাদি দল বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাস উড়িয়ে দেয়। এতে ২৯ জন নিহত হয়। এর কিছুদিন আগে হেজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিকে হত্যা করা হয়। এই আক্রমণের জন্য ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করা হয়। ইসরায়েলের জন্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ব্যর্থ করা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যাতে করে আয়াতুল্লাহ কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী না হয়। কেবল বেসামরিক উদ্দেশ্যে সেটি চালানো হচ্ছে– ইরানের এমন দাবি ইসরায়েল কখনোই বিশ্বাস করেনি। এমনকি এই ধারণাও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ইসরায়েল স্টাক্সনেট কম্পিউটার ভাইরাস তৈরি করে, যা দুই হাজার সালের প্রথম দশকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর গুরুতর ক্ষতি করেছিল।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বাধা দেয়া ইসরায়েলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে
তেহরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা কয়েকজন প্রধান বিজ্ঞানীর ওপর হামলার জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের দায়ী করে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০২০ সালে এর সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা করা। ইসরায়েল সরকার অবশ্য কখনোই ইরানি বিজ্ঞানীদের মৃত্যুর সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি। ইসরায়েল তার পশ্চিমা মিত্রদের সাথে মিলে অতীতে তার ভূখণ্ডে ড্রোন এবং রকেট হামলার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সাইবার হামলার ঘটনায় ইরানকে অভিযুক্ত করেছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ছিল দুই দেশের দ্বন্দ্বের আরেকটি কারণ। পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রমতে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাওয়া বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেসময় অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষক পাঠায় ইরান। এতে ইসরায়েলে বিপদের ঘণ্টা বাজে, কেননা তারা বিশ্বাস করে করে লেবাননে হেজবুল্লাহকে সরঞ্জাম এবং অস্ত্র পাঠানোর জন্য ইরানিদের অন্যতম প্রধান পথ হলো প্রতিবেশী সিরিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা পোর্টাল স্ট্র্যাটফোর অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েল এবং ইরান উভয়ই সিরিয়ায় কর্মকাণ্ড চালিয়েছে যার উদ্দেশ্য অন্য পক্ষকে বড় আকারের আক্রমণ শুরু থেকে বিরত রাখা। ২০২১ সালে এই "ছায়া যুদ্ধ" সমুদ্রেও পৌঁছেছিল। সেই বছর ওমান উপসাগরে ইসরায়েলি জাহাজে হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করেছিল ইসরায়েল। অন্যদিকে লোহিত সাগরে তাদের জাহাজে হামলার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে ইরান।

নিজেদের পরমাণু কর্মসূচির প্রধানকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে ইরান।
ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি মিলিশিয়া হামাসের আক্রমণ এবং এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরুর পর বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষক এবং সরকারপ্রধানরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল যে এই সংঘাত অঞ্চলটিতে একটি চেইন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ইরানি এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে উন্মুক্ত ও সরাসরি সংঘর্ষ উস্কে দিতে পারে। পশ্চিম তীরের অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের সাথে সংঘর্ষের মতোই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লেবানন সীমান্তে হেজবুল্লাহর সাথে জড়িত মিলিশিয়াদের সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর সংঘর্ষ বেড়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ইরান এবং ইসরায়েল উভয়ই তাদের শত্রুতাকে বড় আকারের যুদ্ধে রূপ দেয়ার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও তেহরানের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর পরিস্থিতি বদলে যায়।

গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণ ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে বৈরিতা পুনরুজ্জীবিত করেছে
ভায়েজের মতে, “পরিহাসের বিষয় হলো যে কেউই এখন বড় আকারের সংঘাত চায় না। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের ছয় মাস পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে এর সুনামে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং একে আগের চেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে”। বিশ্লেষরা সতর্ক করেছেন, হামাসের বিপরীতে ইরান ‘একটি রাষ্ট্র আর তাই অনেক বেশি শক্তিশালী’। কিন্তু একই সময়ে, “এটির অনেক অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে’ এবং আরোপিত ধর্মীয় বিধিনিষেধে বিরক্ত নারীদের নেতৃত্বে কয়েক মাস বিক্ষোভের পর ‘অভ্যন্তরীণভাবে এর সরকার বৈধতা সঙ্কটে ভুগছে’।

দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলায় বেশ কয়েকজন জেনারেল নিহত হবার ঘটনা ইরানকে ক্ষুব্ধ করেছে
দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলায় ১৩ জন নিহতের মধ্যে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের সিনিয়র কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি ও তার ডেপুটি হাদি হাজরিয়াহিমির মৃত্যু তেহরানকে বিশেষ আঘাত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন ‘আগ্রাসনকারীর জন্য শাস্তির’ শপথ করে এবং সিরিয়ায় তার রাষ্ট্রদূত হোসেইন আকবরী ঘোষণা করেন যে এর বিরুদ্ধে অবশ্যই ‘কার্যকর পদক্ষেপ’ নেয়া হবে। দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলে ইরানের পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, সবশেষ শুক্রবার ইরানে ইসরায়েলের হামলা- দুই দেশের বৈরি সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিতে যাচ্ছে কি না সে প্রশ্নই এখন উঠে আসছে।
প্রতিবেদক : গুইল্লেরমো ডি. ওলমো, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস