শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে যেভাবে চমক দেখালেন
-
আপলোড সময় :
২২-০৯-২০২৪ ১১:৫২:৩৭ অপরাহ্ন
-
শ্রীলঙ্কার মার্ক্সবাদী নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে । ছবি: এপি
বিশ্লেষণ
লেখা: সরোজ পাথিরানা
৫৫ বছর বয়সী অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামে রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্ব দেন। এই জোটটি এর আগে এমনকি বিরোধী দলও ছিল না। দেশটির ২২৫ সদস্যের সংসদে তাদের আসন ছিল মাত্র তিনটি। এই দলকে ভারতের প্রধান ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ঘনিষ্ঠ বলেই দেখা হয়। সব মিলিয়ে অনূঢ়া এক চমক।
অনূঢ়ার প্রতিদ্বন্দ্বীরা সবাই বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের পরিচিত মুখ। নমাল রাজাপক্ষে, যিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের বড় ছেলে। সজিথ প্রেমাদাসা, যিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমদাসার ছেলে। আর সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, দেশের প্রথম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট জে আর জয়াবর্ধনের ভাগনে।
তাঁদের পেছনে ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। তাঁর জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) এর আগে কখনো ক্ষমতার কাছাকাছিও ছিল না। বরং দুবার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছে।
দলের বাঁকবদল হয় ২০২২ সালে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে আর দেখা দেয় আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি। শুরু হয় গণবিক্ষোভ। সিংহলি ভাষায় যার নাম আরাগালাইয়া, মানে সংগ্রাম। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। এর আগে তাঁর ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দাও পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। দুই ভাই ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন।
আরাগালায়া আন্দোলনের নেতৃত্ব এককভাবে কোনো দল দাবি করেনি। জেভিপি এতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। রাজাপক্ষে ভাইদের পদত্যাগের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষমতার শূন্যতায় দিশানায়েকে এবং জেভিপি বৃহত্তর পরিবর্তনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করেছে। প্রান্ত থেকে দলটি একটি আস্থাভাজন প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দলের সঙ্গে বেড়েছে দিশানায়েকের ব্যক্তিগত আবেদন।
বিদ্রোহ থেকে জনপ্রিয়তা
অনূঢ়ার জন্ম এক গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুলজীবন থেকে জেভিপির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন।
অনূঢ়া ২০১৪ সালে জেভিপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তারপর থেকে তিনি দলের ভাবমূর্তিকে সহিংসতা থেকে আলাদা করায় ব্রতী হন। ১৯৭১ এবং তারপর ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে এই পার্টি মার্ক্সবাদে অনুপ্রাণিত বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল। রাষ্ট্র প্রতিশোধ–পাল্টা প্রতিশোধ নিতে দেরি করেনি। গণগ্রেপ্তার, নির্যাতন, অপহরণ ও গণহত্যায় দলসংশ্লিষ্ট কমপক্ষে ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়। এর মধ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেবিরাসহ বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাও ছিলেন।
দেশের মাথার ওপর যে বিশাল ঋণ তা নিয়ে দিশানায়েকের অবস্থান অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তবে তিনি বর্তমান আইএমএফ প্রোগ্রামের মধ্যে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তবে জনগণকে তিনি ঋণ চুক্তির শর্তগুলো নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আবার আলোচনার কথা বলেছিলেন। জনগণ নিশ্চয়ই তা ভুলে যায়নি। দেশের থিঙ্কট্যাংকরাও মনে করেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতার জন্য আইএমএফ চুক্তির পুনর্বিবেচনা করা অপরিহার্য।
অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর দিশানায়েকে দলের পলিটব্যুরো সদস্য হন। দল সহিংসতার পথ ত্যাগ করে। দিশানায়েকে জেভিপির দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ২০১৪ সালে। সে বছর মে মাসে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি দলের অতীত সহিংস পথকে ভুল বলে উল্লেখ করেন। জেভিপি তার অতীত নিয়ে এই একবারই এমন কথা বলেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দিশানায়েকে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এক বৃহত্তর জোট গড়ে তুলতে পেরেছেন। এই জোটের শরিক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ এবং সামরিক ব্যক্তি, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন। লক্ষণীয়, একসময় জেভিপি এদের গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এখন দলের সবচেয়ে কার্যকর স্লোগান হচ্ছে দুর্নীতি মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি।
১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার পর থেকে, দেশটি শাসন করেছে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বা তাদের জোট বা তাদেরই কোনো অংশ। এরা হলো ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) এবং শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি)।
এই দমবন্ধ করা দীর্ঘ ইতিহাস ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দিশানায়েকই। মানুষ তাতে আস্থা রেখেছে।
সিংহলি বৌদ্ধ বর্ণবাদ আড়াল করে রাখা?
২০২২ সালের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে দিশানায়েকে একটি জনপ্রিয় দুর্নীতিবিরোধী জোট গড়ে তুলেছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি কি দেশের অনেক সমস্যা আড়ালে রেখে দিলেন?
জেভিপি দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কায় ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকেও তারা দেশের ওপর ভারতের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে বিবেচনা করে।
তারা নিজে আগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছিল। কিন্তু জেভিপি বিরোধিতা করেছিল তামিল বিদ্রোহী আন্দোলনের। কারণ, তামিলরা শ্রীলঙ্কাকে বিভক্ত করে একটি পৃথক রাষ্ট্র চাইছিল। ২০০০-এর দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দার আমলে তামিল আন্দোলন যখন চূর্ণ করা হয়, জেভিপি সরকারকে সমর্থন করেছিল। দিশানায়েকে বলেছেন যে তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে রাজাপক্ষে সরকারের যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য তিনি অনুশোচনা করেন না।
তামিল টাইগার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকে গৃহযুদ্ধের সময় সংঘটিত কথিত যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহির দাবি জানিয়ে আসছে। জেভিপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার এ ধরনের কোনো তদন্তের দাবি আমলে নেওয়ার পক্ষে নয়।
এ রকম সব বিষয়ে দিশানায়েকের সমালোচনা আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে দিশানায়েকে সম্পূর্ণরূপে সিংহলি বৌদ্ধ প্রাধান্যকে মেনে নিয়েই রাজনীতি করছেন। তিনি শ্রীলঙ্কায় ঐক্যের পক্ষে যখন কথা বলেন, তা কি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বর্ণবাদী আচরণকে আড়াল করে? জেভিপি সাধারণত সিংহল বৌদ্ধ–দর্শনের সঙ্গেই নিজেকে জড়িত করে। এ অবস্থান সিংহলি বৌদ্ধ যুবকদের আকর্ষণ করেছে। আর সঙ্গে অভিজাত-তন্ত্র বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা তাদের আকর্ষণে আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
বাণিজ্যপন্থী পদ্ধতি
এত কিছুর পর কথা হলো, শ্রীলঙ্কার কাছে আশু সমস্যা তাদের দেশের অর্থনীতি। ২০২২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কা সরকার ঘোষণা করে যে স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো দেশ তার ঋণ খেলাপি হয়েছে। গোতাবায়ার উত্তরাধিকারী প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে দেশের অর্থনীতির হাল ধরার প্রয়াসে আইএমএফ থেকে একটি আর্থিক প্যাকেজের ব্যবস্থা করে।
কিছু বিশ্লেষক এবং বিক্রমসিংহের সমর্থকেরা আইএমএফের সঙ্গে চুক্তির প্রশংসা করেছেন। তবে দিশানায়েকে বলেছেন যে এই চুক্তি শ্রীলঙ্কার সাধারণ নাগরিকদের জন্য কষ্ট ডেকে আনবে। জেভিপি চুক্তির শর্তগুলো নিয়ে পুনরায় আলোচনা করার পক্ষপাতী।
চুক্তির পর সরকার কর বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস এবং সরকারি খাতের সংস্কার প্রবর্তন করে। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। সরকার সামাজিক কল্যাণ সহায়তা হ্রাস করে। কর বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাসের প্রভাবে জ্বালানি এবং বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দাম হয় আকাশছোঁয়া। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোকে হয়ে পড়ে দিশাহারা।
তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই যে দিশানায়েকে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক নীতির কথা বলছেন, এর সঙ্গে তাঁর ঐতিহ্যগত সমাজতান্ত্রিক অবস্থানের এক বাঁকবদল ঘটে গেছে। তিনি এখন শুল্ককাঠামোর সরলীকরণ, ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি, কর প্রশাসনের সংস্কার, দুর্নীতির অবসান এবং ব্যক্তিগত খাতকে প্রবৃদ্ধির চালক হিসেবে দাঁড় ওপর জোর দিয়ে একটি বাণিজ্যসহায়ক পদ্ধতির পক্ষে কথা বলেন ।
দেশের মাথার ওপর যে বিশাল ঋণ তা নিয়ে দিশানায়েকের অবস্থান অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তিনি বর্তমান আইএমএফ প্রোগ্রামের মধ্যে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তবে জনগণকে তিনি ঋণ চুক্তির শর্তগুলো নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে আবার আলোচনার কথা বলেছিলেন। জনগণ নিশ্চয়ই তা ভুলে যায়নি।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা
নিউজটি আপডেট করেছেন : Admin
কমেন্ট বক্স